ওগো কাঙাল আমার
*********************
শ্যামাপ্রসাদ সরকার
(১)
সারাটা সকাল অপেক্ষা করেই কাটল বনানীর। রবিবার করে হিমাংশুর পথ চেয়ে থাকাটা গত আট বছরের অভ্যাস। এই অপেক্ষাটুকুই রয়ে গেছে শুধু, নিজের করে পাওয়াটুকু মনে হয় বাকিই রয়ে যাবে।
রমেন যখন পাঁচ বছরের বিবাহিত সম্পর্কের ইতি টেনে চলে যায় বনানী তখন সবে আঠাশ পার করেছে। ওদের একমাত্র ছেলে বুবুন অটিজমে আক্রান্ত। মনোবিকাশ কেন্দ্রে ছেলের চিকিৎসা, সংসার সব কিছু একা হাতে সামলাতে তখন হিমসিম খাচ্ছে সে। তখনই হিমাংশুদের অফিসে রিসেপশনিষ্টের কাজটা পায়। হিমাংশুও তখন ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে একটা ব্যর্থ দাম্পত্যের বোঝা বইতে বইতে। ওরও একটা বারান্দার দরকার ছিল যেখানে একবার নিভৃতিতে নিঃশ্বাস নিতে পারে দিনান্তে। বনানীর তরফে এই সম্পর্কটায় প্রথম প্রথম সায় ছিল না মোটেও। ঘরপোড়া নিজেই, নেহাত চাকরিটা না থাকলে ছেলের খরচ যোগানো মুশকিল, তাই চাকরি করতে আসা। রমেন অবশ্য কিছুদিন পাঁচহাজার করে পাঠিয়েছিল। নিজে নতুন বিয়ে করে সেও যখন আবার সংসার পাতলো বসিরহাটে, তখন থেকে সেটুকু সম্বন্ধও ঘুচল। ওর মামারা বাপ মা মরা ভাগ্নীর বিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে নিয়েছিল, কাজেই আক্ষরিক অর্থেই বনানীর দাঁড়ানোর আর কোনো জায়গা ছিলনা। আসলে ছেলেটা অমন হওয়ায় রমেন ওকেই বরাবর দোষ দিত। ওর ধারণা ছিল বনানীদের পরিবারের জিনের কোনো খুঁতের জন্যই বুবুনটা এরকম প্রতিবন্ধী হল। রমেন ছেলেকে দুচক্ষে দেখতে পারতো না প্রথম থেকেই । শেষের দিকে তো ও আলাদা বিছানায় ছেলেকে নিয়ে শুত।
হিমাংশুর স্ত্রী স্কিৎসোফ্রেনিক। সবসময় অন্য একটা অদ্ভূত ঘোরে থাকে। প্রথমটায় অবশ্য এমন ছিলনা। দুবার মিসক্যারেজ হবার পর থেকে একটা ফ্রিজিডিটি ওকে আস্তে আস্তে ঘিরতে থাকে। ক্রমশঃ হিমাংশুকে আর সহ্য করতে পারতো না। খুব ভায়োলেন্ট হয়ে যেত। জিনিস পত্র ভাঙচুর করতে গিয়ে আহত হয়েছে কতবার ! সুইসাইড এ্যটেম্প্ট পর্যন্ত করেছে। একটা হোমে রেখে আটবছর হল ওর চিকিৎসা করায় হিমাংশু। এই অবস্থায় ডিভোর্স করাটা খুব অমানবিক দেখাবে, তাই মালবিকাকে ছেড়ে বের হতে পারেনি যেমন, তেমন বনানীকেও অমর্যাদা করতে পারেনি। ভালবাসার কাছে ও অনুগত। কিন্তু মালবিকার জীবদ্দশায় ওর ফ্ল্যাটে বনানীকে রেখে ওকে অপমান করতে ওর বাধে। তাই রোববার সারাটা দিন বনানীর কাছে ও এসে থাকে। বনানীর খরচাপাতিও ওই দেয় আজকাল। তবুও কোথাও একটা অদৃশ্য কাঁটা বিঁধেই থাকে। বনানী আর হিমাংশু এখন আর এক অফিসে চাকরি করেনা অবশ্য। চাকরি ছেড়ে হিমাংশু এখন কন্ট্রাকটরির কাজ শুরু করেছে পার্টনারশিপে। শহরতলির দু একটা মাঝারিমাপের প্রোজেক্টের কাজ জোরকদমে চলছে এখন।
মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগের ডাল হিমাংশুর প্রিয় বলে আজ বানিয়েছিল বনানী। সঙ্গে আলুপোস্ত আর কাটাপোনার ঝোল। বাজারটা নিজেই করতে ভালবাসে ও। সপ্তাহান্তে একটা দিন মানুষটাকে একটু ভালো রান্না করে খাওয়াতে পারলে শান্তি লাগে। কিন্তু হিমাংশু আজ এখনো এলোনা কেন? সকাল থেকেই মোবাইলও বন্ধ আছে। এমন তো হয়না কখনোও ! বনানীর বুকের ভিতর অমঙ্গল আশঙ্কায় দুরুদুরু করে।
গতসপ্তাহে এসেছিল যখন হিমাংশু, শার্টের একখানা বোতাম ছেঁড়া দেখেছিল বনানী। এ বাড়িতে ওর দু তিন সেট কাপড় জামা থাকেই, তাই সেলাই করবে বলে সেদিন জামাটা রেখে দিয়েছিল। বোতামটা বসানোর কথা হঠাৎ মনে পড়তেই তড়িঘড়ি সেলাই এর সরঞ্জাম নিয়ে বসে পড়ে বনানী। বুবুনের খাওয়ার এখনো একটু দেরী আছে। জামাটা সযত্নে বুকের কাছে চেপে ধরে ও। একটা পুরুষালী গন্ধ রয়ে আছে ওতে। সেবার রাঁচি বেড়াতে গিয়ে ছাতিম ফুলের গন্ধে ওর একই সঙ্গে আদর আর কান্না পেয়েছিল। শার্টটায় বোতাম বসাতে বসাতে সেই আবেগঘন দুপুরটার কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ।
পাড়ায় খুব একটা কারোর সাথে মেশেনা বনানী। একটা চাপা গুঞ্জন যে ওকে নিয়ে হয়; সেটা বেশ বোঝে। হিমাংশুর আসা নিয়েও যে একটা মাখো মাখো পেঁয়াজ রসুনের গন্ধওলা চর্চা চলে তাও বুঝতে অসুবিধা হয়না। একদম সামনের ফ্ল্যাটের শিশির রোজারিওদের বাদ দিলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বেশী কথা বলার দরকার পড়েনা অবশ্য।
বুবুনকে খাইয়ে দিতে হয় এখনো। সেটা সারতে সারতে আড়াইটে বাজল। হিমাংশুর ফোন এখনো বন্ধ। উৎকন্ঠাটা ক্রমশ বাড়ছে এবার। মালবিকার কিছু হলনা তো আবার ! হিমাংশু বলছিল যে প্যানক্রিয়াসের কি একটা যেন ইনফেকশনে কদিন ধরে ভুগছিল মালবিকা। হিমাংশুকে নিজের করে পাওয়ার আশা একেবারে ত্যাগ না করলেও
মালবিকার মৃত্যু কামনার কথা কখনো কখনো যে ভাবেনি তা নয়। পরমুহূর্তেই আবার সে কথা ভেবে মা কালীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। নিজের কাঙালপনার মূল্যে অন্য কারোর মরণকামনা করা যে পাপ !
**********
(২)
আজ রোববার হলেও সাইটে আসতে হয়েছিল। কৈখালির প্রজেক্টটা একটা গেরোয় ফেঁসেছে। হিমাংশু আর তার পার্টনার জয়দীপ এই জটটা ছাড়াতে কাউন্সিলারের অফিসে দেখা করতে গেছিল। তাড়াহুড়োয় ফোনটা আজ ওবাড়িতে ফেলে এসেছে। দুপুর গড়িয়ে গেল, মাঝখানথেকে এখনও বনানীর সাথে একবারও কথা হলনা।
চট করে সে বাইরের কারোর ফোন থেকে বনানীকে ডায়াল করেনা। বনানীর ব্যাপারটা আজীবনের যত্নলালিত এক গোপনীয়তা যেন। এই ভীরুতা ওকেও ভাবায়। সবার চোখে ভালমানুষ হয়ে থাকার মোহতে ও ভালবাসার প্রতি অবিচার করছে যদিও।
বনানীর ছটফটানিটা ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। রান্না গুলো জুড়িয়ে গেছে কখন। সে নিজেও অভুক্ত। ঘড়ির সময় একটা একটা সংখ্যার ঘর পার করে যাচ্ছে অবলীলায়। মাথাটা টিপটিপ করে যন্ত্রণা করছে আবার। এইবার একটা ছায়ার মত অন্ধকার ঢেকে আসবে আস্তে আস্তে। হিমাংশুকে লুকিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছে অবশ্য। ব্রেন টিউমার সন্দেহ করছে ডাক্তার ঘোষ। এবারে একটা সি টি স্ক্যান করার কথা। ব্যাপারটা আর লুকিয়ে রাখা যাবেনা হিমাংশুর থেকে। মাথার ভেতরের তীব্র যন্ত্রণার দপদপানিটা বাড়তে থাকে ক্রমশঃ।
সাইট থেকে বেড়িয়ে ট্যাক্সি পেতে বেশ বেগ পেতে হল আজ। এখন প্রায় এক ঘন্টা লাগবে বনানীর কাছে পৌঁছাতে। অধৈর্য হয়ে সিগারেট ধরায় হিমাংশু ট্যাক্সিতে বসে বসেই।
নিজের কিছু হলেই বুবুনের কথা সবার আগে মনে পড়ে। ও বেচারাই সবচেয়ে অসহায় এই পৃথিবীতে। সবাই এমনকি হিমাংশুও বোধহয় কাটিয়ে উঠতে পারবে বনানীর অনুপস্থিতি কিন্তু বুবুন? ও বেচারা বোধহয় বাঁচবেই না আর !
অনেক দূর থেকে একটা নীলাভ আলো আসছে অন্ধকার একটা বিন্দু থেকে। অসংখ্য ধূলিকণার একটা স্তর সেই আলোর পথ জুড়ে ভাসছে। কি সুমধুর একটা শব্দ মন্দ্রিত হচ্ছে তার সঙ্গে। কত আলোর তরঙ্গ, রঙীন স্প্রেকট্রামের মত আসছে আর যাচ্ছে। বুবুন যেন অস্থির হয়ে উঠলো একটু ! রমেন কি এখনো ওদের ভালবাসতে পারবে না ! মালবিকার ডান বুকে একটা তিল আছে না? হিমাংশু বলে
ফেলেছিল একবার! আলু পোস্তটার তলাটা ধরে গন্ধ বের হচ্ছে, পোড়া একটা ধোঁয়াটে গন্ধ। চামড়া পুড়ছে? সব পুড়ে যাচ্ছে যেন ধিকিধিকি আগুনে ! ট্যাক্সি থামল একটা যেন। অচৈতন্য হতে আর বেশী বাকী নেই।
"হিমাংশু এলে? হিমাংশু এলে? এত দেরী !
এত দেরী করলে কেন তুমি?"
সমাপ্ত